উপাসনা
আমরা যাকে কাছে পেতে চাই তার থেকে দূরে বসলে কি আমাদের ভালো লাগে? নিশ্চয়ই না। যাকে ভালো লাগে তার কাছে বসতে চাই। ঈশ্বরকে ভালোবেসে তাঁর কাছে আমরা বসতে চাই। ঈশ্বরের কাছে বসাই উপাসনা। ধর্মগ্রন্থে উপাসনা নিয়ে অনেক কথা আছে। সে কথাই এখন আমরা জানব।
'উপ' অর্থ নিকটে এবং 'আসন' অর্থ বসা। ঈশ্বরের উপাসনা অর্থ ঈশ্বরের নিকটে বসা। অর্থাৎ, যে কর্মের মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরকে কাছে পেতে পারি, তার নাম উপাসনা। একাগ্রচিত্তে ভক্তিভরে ঈশ্বরের আরাধনা করাই উপাসনা। উপাসনা ধর্মপালনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ বা পদ্ধতি। পূজা-অৰ্চনা, স্তব-স্তুতি, ধ্যান, জপ, কীর্তন, প্রার্থনা প্রভৃতি পদ্ধতিতে উপাসনা করা হয়। উপাসনার ফলে আমাদের দেহ-মন পবিত্র হয়। উপাসনার মাধ্যমে আমরা সকলের কল্যাণ কামনা করি। ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।
সাকার ও নিরাকার দুভাবেই ঈশ্বরের উপাসনা করা যায়।
সাকার উপাসনা হলো নিরাকার ঈশ্বরের আকার বা মূর্ত রূপের মাধ্যমে আরাধনা করা। "সাকার' অর্থ যার আকার বা মূর্তরূপ আছে। আমরা ঈশ্বরকে নেব-দেবীর প্রতিমারূপে উপাসনা করি। বিভিন্ন দেব-দেবী, যেমন- কার্তিক, গণেশ, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি ঈশ্বরের সাকার রূপ। পূজারী ভক্ত ঈশ্বরকে সাকাররূপে পূজা করে। তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করে।
নিরাকার মানে যার কোনো আকার বা রূপ নেই। ব্রহ্মের কোনো রূপ নেই। ব্রহ্মই ঈশ্বর। ঈশ্বরের কোনোপ্রকার প্রতীক বা মূর্তরূপ ছাড়া ধ্যানস্থ হয়ে উপাসনা করাই নিরাকার উপাসনা। ঈশ্বর নিরাকার। জগতের কল্যাণে নিরাকার ঈশ্বর সাকার রূপ ধারণ করেন। যিনি নিরাকার, তিনিই আবার সাকার। নিরাকাররূপে ঈশ্বরের উপাসনা হচ্ছে ধ্যান। সাকাররূপে ঈশ্বরের উপাসনা হচ্ছে পূজা। উপাসনা প্রতিদিন করতে হয়। তাই এটি একটি নিত্যকর্ম। উপাসনার আগে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন হওয়া আবশ্যক। একা বসে উপাসনা করা যায় আবার কয়েকজন মিলে একসাথে বসেও উপাসনা করা যায়। কয়েকজন একত্র হয়ে উপাসনা করাকে সমবেত উপাসনা বলা হয়।
ঈশ্বরের উপাসনায় দেহ-মন পবিত্র হয়। উপাসনা আমাদেরকে সৎপথে বা ধর্মপথে পরিচালিত করে। সকলের কল্যাণ কামনায় আমরা নিয়মিত উপাসনা করব।
প্রার্থনা
আমরা কেউ পরিপূর্ণ নই। প্রত্যেকেরই কিছু চাওয়া পাওয়া আছে। বড়দের কাছেও চাই আবার ছোটদের কাছেও চাই। তবে কেবল অভাবের জন্যই আমরা চাই না। ভালো থাকার জন্যও চাই। নিজের এবং সকলের মঙ্গলের জন্যও চাই। এই চাওয়ার একটা অর্থ প্রার্থনা। এখন আমরা প্রার্থনা সম্পর্কে জানব।
ঈশ্বর সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি দয়াময়। করুণাময়। তাঁর ইচ্ছার উপরেই আমাদের সবকিছু নির্ভর করে। আমরা তাঁর কাছেই সবকিছু চাই। ঈশ্বরের কাছে ভক্তিমনে কিছু চাওয়াই হচ্ছে প্রার্থনা। উপাসনার একটি অঙ্গ হলো প্রার্থনা। প্রার্থনা করার আগে নিজেকে শুচি করতে হয়। পবিত্র হতে হয়। মনে বিনয়ীভাব থাকতে হয়। একা বা সমবেতভাবেও প্রার্থনা করা যায়। আমরা নিজের ও সকলের কল্যাণ কামনা করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে থাকি।
স্তব-স্তুতি ও
প্রার্থনামূলক কবিতা
হিন্দুধর্মের অনেক ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতা শ্রীশ্রীচণ্ডী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব ধর্মগ্রন্থে ঈশ্বরের স্তব ও প্রার্থনামূলক অনেক মন্ত্র ও শ্লোক রয়েছে। সেখানে ঈশ্বর ও দেব-দেবীর রূপ, গুণ, মাহাত্ম্য প্রভৃতি বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সহ মহান ব্যক্তিদের রচিত বাংলা ভাষায় অনেক প্রার্থনামূলক কবিতা রয়েছে। এসব মন্ত্র, শ্লোক, প্রার্থনামূলক কবিতা চৰ্চা করলে মন পবিত্র হয়। মনে ঈশ্বরের উপলব্ধি অনুভূত হয়।
আমরা এখন ধর্মগ্রন্থাবলি থেকে সরলার্থসহ কিছু মন্ত্র ও শ্লোক এবং প্রার্থনামূলক বাংলা কবিতা শিখব।
অসতো মা সাময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ)
শব্দার্থ : অসতো (অসতঃ) অসৎ থেকে সদাময় (সংগময়)- সত্যে নিয়ে যাও; তমসো (তমসঃ)- অন্ধকার থেকে: জ্যোতির্গময় (জ্যোতিঃ + গময়) - জ্যোতিতে অর্থাৎ আলোতে নিয়ে যাও; মৃত্যোর্মা (মৃত্যোঃ+মা); মৃত্যোঃ- মৃত্যু থেকে; মা, আমাকে অমৃতং-অমৃতে, গময়-নিয়ে যাও।
সরলার্থ : আমাকে অসত্য থেকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে যাও।
নহি আনেন সদৃশং পৰিত্ৰমিহ বিদ্যতে
তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিদতি ।।
(শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা-৪/৩৮)
শব্দার্থ :- ন নাই; হি - অবশ্যই; আনেন জ্ঞানের; সদৃশম্ সমান/তুল্য: পবিত্রম্ পবিত্ৰ ইহু এই জগতে; বিদ্যুতে বিদ্যমান তৎ তা স্বরম্ নিজে যোগসংসিক যোগ সিদ্ধগণ; কালেন - কালক্রমে/যথাসময়ে আত্মনি আত্মাতে; বিন্দতি - অনুভব করেন।
সরলার্থ এই জগতে জ্ঞানের তুলা পবিত্র আর কিছুই নেই। যোগসিগণ যথাসময়ে সে জ্ঞানকে নিজ আত্মাতে অনুভব করেন।
সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে
শরণ্যে ত্রাম্বকে গৌরি নারায়নি নমোহস্তু তে। (১১/১)
শব্দার্থ: সর্বমঙ্গলমঙ্গলো সকল মঙ্গলের মঙ্গল স্বরূপা; শিবে কল্যাণদায়িনী; সর্বার্থসাধিকে (সর্ব+ অর্থসাধিকে) সকল প্রকার সিন্ধি সুফল) প্রদায়িনী; শরণ্যে আশ্রয়স্বরূপা; গ্রাসকে - গ্রিনয়না: গৌরি - গৌরবর্ণা: নমোহস্তু তেঅনমোঃ+অন্তু তে) - তোমাকে নমস্কার।
দ্রষ্টব্য: স্ত্রীলিঙ্গে অর্থা)-কারান্ত শব্দের সম্বোধনের একবচনে এ(0-কার এবং নী)-কারান্ত শব্দের সম্বোধনের একবচনে ই-কার হয়।
সরলার্থ: হে নারায়ণী, গৌরী, তুমি সকল মঙ্গলের মঙ্গল স্বরূপা, কল্যাণদায়িনী, সকল প্রকার সুফল প্রদায়িনী, আশ্রয় স্বরূপা, ত্রিনয়না তোমাকে নমস্কার।
অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে-
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে।
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ ।
সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত নিস্পন্দিত করো হে।
নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে।
(গীতাঞ্জলি)
Read more